আমাদের দেশে কুল ঐতিহ্যবাহী একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমি ফল। স্বাদ ও পুষ্টিমানের বিচারে কুল একটি উৎকৃষ্ট মানের ফল। বিশেষ করে ভিটামিন সি-এর দিক থেকে আমলকী ও পেয়ারার পরই এর জায়গা। মানব দেহের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য ও ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ এর সহজ ও সস্তা উৎস হচ্ছে কুল। কুল শুধু ফল হিসাবেই নয় এ থেকে আচার, চাটনি ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরি করা হয়। ভিটামিন-সি হৃদরোগকেও প্রতিরোধ করে এবং কুলে পাওয়া যায় এমন ফ্রি র্যাডিক্যালগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। ভেষজ গুণেও কুল অনন্য। কবিরাজি মতে, কুল রক্ত শোধন ও রক্ত পরিষ্কার এবং হজমিকারক। পেটে বায়ু ও অরুচি, অতিসারে প্রদর রোগে কুল থেকে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করা যায়।
আমাদের দেশে প্রায় ২৭৫০ হাজার হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয় এবং উৎপাদন প্রায় ৭২০০০ মেট্রিক টন। বর্তমানে আপেল কুল, বাউ কুল, বারি কুল-১, বারি কুল-২, বারি কুল-৩ ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে। তবে কুল চাষে এর আগে পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন দেখা না গেলেও বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং কুল চাষ বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু পোকা কুলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে কুলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ফসলটি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এ পোকামাকড়ের মধ্যে কুল বাগানে ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা ও টিউব স্পিটল বাগ পোকা অন্যতম।
ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা
ফল ছিদ্রকারী উইভিল কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতিকারক পোকা। কয়েক বছর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুলের উন্নত জাতে এ পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। পোকার সদ্যজাত লার্ভা হালকা হলুদ বর্ণের এবং এদের পা থাকে না। পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণের হয়। পূর্ণ বয়স্ক পোকা কচি ফলে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে লার্ভা ও পিউপা থেকে পূর্ণ রূপ ধারণ করে।
ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকা যেভাবে কুলের ক্ষতি করে থাকে -
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়ার সূত্র মতে, সদ্য জাত লার্ভা কচি ফলের বীজে আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণ বীজ খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত ফলের নিচে কাল দাগ পড়ে এবং বীজের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, ফল ছোট গোলাকার হয় এবং ফ্যাকাশে ও হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আক্রান্ত ফল গাছ থেকে ঝরে পড়ে বা গাছ শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ফলে পোকার লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকার মল দেখা যায়। ফলের ভেতরের অংশ খাওয়ার পর গোলাকার ছিদ্র করে পোকা বের হয়ে আসে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে বাগানের সব গাছের ফল আক্রান্ত হয়। তবে আপেল কুল ও বাউ কুলে আক্রমণ বেশি হয়। সাধারণত গাছে ফুল আসার পর এ পোকার আনাগোনা দেখা যায় এবং পরাগায়নের পর গাছে ফল ধরা শুরু হলে পোকার আক্রমণ শুরু হয়।
এ পোকা দমনের জন্য যা করতে হবে-
কুল বাগানের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল ও আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
কুল গাছে অসময়ে আসা ফুল ও কুড়ি নষ্ট করে ফেলতে হবে।
গাছ ও মাটিতে পড়ে যাওয়া আক্রান্ত ফলগুলো সংগ্রহ করে লার্ভা বা পিউপা বা পূর্ণ বয়স্ক পোকাসহ ধ্বংস করতে হবে।
বেশি আক্রান্ত এলাকায় ফুল ধরার আগেই সব বাগান ও এলাকা অনুমোদিত কার্বারাইল জাতীয় কীটনাশক বা ডাইমেথোয়েট জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
যেহেতু পোকাটি ফলে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ফলের ভেতর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় সেজন্য আক্রমণের আগেই পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য পরাগায়নের পর ফল ধরা শুরু হলে সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
টিউব স্পিটল বাগ
সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বগুড়ার সূত্র মতে, এ পোকা কুল গাছের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে থাকে এবং এর আগে কখনও এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়নি। পোকার নিম্ফগুলো সরু, লম্বা চুন যুক্ত টিউবের মধ্যে অবস্থান করে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। নিম্ফগুলো টিউবের মধ্যে তাদের তৈরি ফ্লুয়িডে (fluid) নিজেকে লুকিয়ে রাখে এবং টিউবে এদের মাথা নিচে এবং পেট ওপরে রাখে। নিম্ফগুলোর পেটে একটি বর্ধিত প্লেট থাকে যা টিউবের খোলা প্রান্তে দরজা হিসাবে কাজ করে এবং টিউবকে বন্ধ করে দেয়।
ক্ষতির প্রকৃতি
পূর্ণ বয়স্ক পোকা এবং নিম্ফ ফুল থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত ফুল সম্পূর্ণ রূপে শুকিয়ে যায় এবং ফল ধারণের অনুপযোগী হয়। অধিক আক্রান্ত গাছ সম্পূর্ণ রূপে ফল ধারণে ব্যর্থ হয়। এরা মধু রস নিঃসৃত করে যেখানে শুটি মোল্ড জন্মে। ছায়াযুক্ত স্থানে আক্রমণ বেশি হয়। সাধারণত কুল গাছে ফুল আসার সময় আক্রমণ বেশি হয় এবং টিউবের মধ্যে নিম্ফ দেখা যায়। পরবর্তীতে ফুল ধরা শেষ হলে এরা টিউব ছেড়ে চলে যায় এবং গাছে শুধু খালি টিউব পড়ে থাকে।
দমন ব্যবস্থাপনা
জমি সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে যাতে ডালপালায় পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায়। ছায়াযুক্ত জায়গায় কুল চাষ না করাই উত্তম।
হাত বা শক্ত লাঠি দিয়ে টিউবগুলো নিম্ফসহ ধ্বংস করতে হবে।
যেহেতু ফুল ধরার সময় এ পোকার আক্রমণ দেখা যায় সেজন্য গাছে ফুল আসার সময়ে কা- বা শাখায় টিউব দেখামাত্র সাইপারমেথ্রিন বা ফেনভেলারেট জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
সাথি ফসল চাষ
বাণিজ্যিকভাবে লাগানো কুলের বাগানে প্রথম ৪-৫ পর্যন্ত আন্তঃফসল হিসাবে শীতকালীন শাকসবজি পেঁপে, ডালজাতীয় ফসল চাষ করা যেতে পারে। এতে বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। রোগ বালাই পোকার উপদ্রব ও আক্রমণ থেকে বাগানকে রক্ষা করা যায়।
রোগে আক্রান্ত এলাকায় করণীয়
অত্যধিক আক্রান্ত এলাকায় গাছে ফুল ধরার আগে বাগানের সব গাছ ও এর আশপাশের এলাকায় কার্বারাইল (সেভিন ৮৫ এসপি বা কার্বারাইল ৮৫ ডব্লিউপি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা ডাই মেথোয়েট (টাফগর ৪০ ইসি বা সানগর ৪০ ইসি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনা
চারা গাছ লাগানোর ১ মাস পর চারা গাছের চারদিকে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। জৈব সার হিসাবে পচা গোবর, হাঁস-মুরগির বিষ্টা পচানো কম্পোস্ট সার, খৈল ইত্যাদি প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাসায়নিক সার ভিন্ন বয়সের গাছে ভিন্ন অনুপাতে দেয়া হয়। কুলের উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও অধিক ফলনশীলতার জন্য গাছে নিয়মিত ও পরিমাণমতো সার দিতে হবে। সারের মাত্রা নির্ভর করে গাছের বয়স, আকার ও মাটির উর্বরতার ওপর। নিম্নে বিভিন্ন বয়সের গাছে সারের মাত্রা দেয়া হলো-
গাছের বয়স (বছর)
|
পচা গোবর (কেজি)
|
ইউরিয়া (গ্রাম)
|
টিএসপি (গ্রাম)
|
এমওপি (গ্রাম)
|
১-২ ৩-৪ ৫-৬ ৭-৮ ৯ বা তদুর্ধ |
১০ ২০ ২৫ ৩৫ ৪০ |
২৫০-৩০০ ৩৫০-৫০০ ৫৫০-৭৫০ ৮০০-১০০০ ১১৫০-১২৫০ |
২০০-২৫০ ৩০০-৪৫০ ৫০০-৭০০ ৭৫০-৮৫০ ৯০০-১০০০ |
২০০-২৫০ ৩০০-৪৫০ ৫০০-৭০০ ৭৫০-৮৫০ ৯০০-১০০০ |
উপরোক্ত সার বছরে সমান দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি মে-জুন মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তি ফল ধরার পর পরই অর্থাৎ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে প্রয়োগ করতে হবে। সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
তরল সার প্রয়োগ
গাছে এক ধরনের জৈব তরল সার ব্যবহার করতে পারেন। তরল সার তৈরি পদ্ধতি : খৈল ১ কেজি, গোবর ২ কেজি, পানি ৫০ লিটার ও কুচামাছ ২৫০ গ্রাম একই সঙ্গে পানিতে ৭ দিন পচিয়ে তরল সার তৈরি করে কুল গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করবেন। খেয়াল রাখতে হবে তরল সার প্রয়োগের সময় জমিতে যেন রসের টান না থাকে সেজন্য সেচ দেয়ার ৩০ মিনিট পর এ সার প্রয়োগ করা উচিত এতে ফল গাছের উপকার হয়।
হরমোন ও দস্তা-বোরনের ব্যবহার
বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণ ছাড়াও অন্য কারণে কুলের ফুল ও ফল ঝরে পড়তে পারে। যেমন- হরমোনের অসামঞ্জস্যতা, পুষ্টি উপাদানের অভাব বিশেষ করে দস্তা ও বোরনের অভাব। হরমোনের অভাবে প্লানোফিক্স নামক হরমোন স্প্রে করতে হবে। দস্তার অভাব হলে জিংক সালফেট ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। চিলেটেড জিংক ০.৫ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। বোরনের অভাব কুল ফেটে যায়। এজন্য সলুবর বা বাম্পার সলুবর ২ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
প্রুনিং বা ছাঁটাই
গাছের অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম বছর গাছের অবকাঠামো মজবুত করার জন্য গোড়া থেকে ৭৫ সেমি. উঁচু পর্যন্ত কোনো ডালপালা রাখা যাবে না। গাছের অবস্থা অনুযায়ী এর ওপরে শক্ত সামর্থ্য ৩-৪টি শাখা প্রশাখা রাখতে হবে যাতে গাছ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে পারে। ফল সংগ্রহের পর প্রতি বছর কুল ফসল সংগ্রহের পর ১ বার ছাঁটাই করা উচিত। ছাঁটাইয়ের সময় শক্ত শাখাগুলো গোড়া থেকে না কেটে কিছু রেখে অগ্রভাগ কেটে ফেলতে হবে। একে অতি ছাঁটাই Heavy (pruning) বলে। ফল সংগ্রহ শেষ হলে মাঘ-ফাগ্লুন মাসে ২ সেমি. মোটা পর্যন্ত সব ডাল ছেটে দেয়া প্রয়োজন। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ এড়ানো যায়। এছাড়া সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে হালকা করে কিছু কিছু ডাল ছেটে দিলে গাছে বেশি কুল ধরে। ফলে বাগান মালিক লাভবান হয়।
উপযুক্ত যত্ন ও পরিচর্যার দ্বারাই একটি কুল গাছ বা কুল বাগান থেকে আশানুরূপ ভালো গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিক ফলন আশা করা যায়। কুল বাগানে প্রথম ৪-৫ বছর শীতকালীন ও অন্যান্য ডাল জাতীয় ফসল চাষ করে তা থেকে আলাদা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
কৃষিবিদ মোঃ আব্দুল্লাহ-হিল-কাফি*
*আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী